বাজেটে আইএমএফ’র শর্তসহ ৬ চ্যালেঞ্জ

তাহানুল মারুফ
মে ১০, ২০২৩

Share Now

আগামী অর্থবছরের (২০২৩-২৪) বাজেট বাস্তবায়নে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত পূরণসহ ছয় চ্যালেঞ্জ দেখছে অর্থ বিভাগ। এর মধ্যে প্রধান চ্যালেঞ্জ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ।

এজন্য খসড়া বাজেটে ব্যয়ের প্রবৃদ্ধির লাগাম টেনে ধরা হয়েছে। জিডিপির অনুপাতে মোট ব্যয় চলতি অর্থবছরের মতো একই থাকছে আগামী দিনেও। অন্যসব চ্যালেঞ্জ হচ্ছে-বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ স্থিতিশীল রাখা, সুদ ও ভর্তুকি ব্যয়ের টাকার সংস্থান এবং কর ও ব্যক্তি করদাতার সংখ্যা বাড়ানো। এছাড়া অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান সৃজনও চ্যালেঞ্জ হিসাবে দেখা হচ্ছে। আইএমএফ-এর ঋণের বিপরীতেই মূলত এ ধরনের একাধিক শর্ত বাস্তবায়ন করতে হবে।

এমন পরিস্থিতিতেও উচ্চ প্রবৃদ্ধির প্রত্যাশা করছেন অর্থমন্ত্রী। সরকারের বর্তমান মেয়াদের শেষ বাজেট ৭ দশমিক ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরেই তৈরি করা হয়েছে, যা আজ অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল উপস্থাপন করবেন প্রধানমন্ত্রীর কাছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে পাওয়া গেছে এসব তথ্য।

জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, সামষ্টিক অর্থনীতি এখন স্বল্প মেয়াদে সর্ববৃহৎ চ্যালেঞ্জ হিসাবে দেখা দিয়েছে। মূল্যস্ফীতি ও ডলার সংকট অর্থনীতির স্বাভাবিক গতির বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর প্রভাবে মানুষের সঞ্চয় ও ক্রয়ক্ষমতা কমছে। যে কারণে অনেকে ঋণ করে চলছেন। এমন পরিস্থিতিতে আগামী বাজেট ঘাটতির অঙ্ক কমাতে হবে। কারণ, বড় ঘাটতির চাপই মূল্যস্ফীতিকে বাড়িয়ে দেয়। এই অর্থনীতিবিদের মতে, আগামী বাজেটে ঘাটতি সংকোচনের পথে যেতে হবে।

এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত অর্থ বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, প্রধানমন্ত্রীর কাছে পুরো বাজেটের সারসংক্ষেপ উত্থাপন করা হবে। সেখানে বিস্তারিত আলোচনার পর প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে বিশেষ কোনো দিকনির্দেশনা দেওয়া হলে তা অন্তর্ভুক্ত করা হবে। এরপর সারসংক্ষেপ অনুমোদন দেবেন প্রধানমন্ত্রী। পরে চূড়ান্ত করে পহেলা জুন জাতীয় সংসদে ‘জাতীয় বাজেট ২০২৩-২৪’ আকারে ঘোষণা করা হবে।

জানা যায়, প্রধানমন্ত্রীর কাছে বাজেট উত্থাপনের সব ধরনের প্রস্তুতি শেষ করেছে অর্থ বিভাগ। মঙ্গলবার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এ নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করেছেন। আজ সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে বাজেটসংক্রান্ত বৈঠক শুরু হবে। এতে উপস্থিত থাকবেন অর্থমন্ত্রী, পরিকল্পনামন্ত্রী, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান। এছাড়া অর্থ বিভাগ, পরিকল্পনা বিভাগ, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব এবং বাজেটসংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও থাকবেন।

বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে আগামী বাজেটের রূপরেখার পাশাপাশি সব ধরনের চ্যালেঞ্জ, জনসম্পৃক্ত কর্মসূচিগুলো তুলে ধরা হবে। নতুন অর্থবছরে উচ্চ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরার যৌক্তিকতা তুলে ধরবেন অর্থমন্ত্রী। বিশেষ করে আগামী বাজেট ঘোষণার ছয় মাসের মাথায় জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ফলে নির্বাচনি বছর ধরে আগামী বাজেটে প্রবৃদ্ধিকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। প্রবৃদ্ধি অর্জনের যৌক্তিকতা হিসাবে বলা হয়েছে, দেশের খাদ্যশস্য উৎপাদন পরিস্থিতি আগামী দিনে ভালো হবে। এছাড়া বাড়বে রেমিট্যান্স, রপ্তানি ও রাজস্ব খাতের আয়ও। বিশ্ববাজারে এরই মধ্যে কমতে শুরু করেছে নিত্যপণ্য, জ্বালানি ও সারের দাম। এর সুফলও মিলবে আগামী দিনগুলোয়। ফলে এগুলো উচ্চতর প্রবৃদ্ধি অর্জনে নিয়ামক হিসাবে কাজ করবে।

যদিও আর্থিক চাপ এখন রয়েছে। এছাড়া নানা ধরনের বিধিনিষেধ আরোপের কারণে এরই মধ্যে আমদানি কমেছে। এতে শিল্পপ্রতিষ্ঠানে উৎপাদন কম হচ্ছে। আর উৎপাদন কমের কারণে রাজস্ব আদায়ও ইতোমধ্যে কমেছে। এছাড়া চলতি অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে সরকার ইতোমধ্যে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ নির্ধারণ করেছে। বিশ্বব্যাংকের ফোরকাস্টে বলা হয়েছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৫ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন হতে পারে।

এদিকে নতুন বাজেটে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসাবে দেখা হচ্ছে মূল্যস্ফীতিকে। কারণ, আগামী দিনগুলোয়ও মূল্যস্ফীতি বহাল থাকবে-এমনটি ধরে নেওয়া হয়েছে। ওই হিসাবে আগামী অর্থবছরের জন্য মূল্যস্ফীতির হার প্রক্ষেপণ করা হয়েছে ৬ শতাংশ। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ তুলে ধরা হবে বৈঠকে। বিশেষ করে মূল্যস্ফীতি থেকে রক্ষা করতে গরিব মানুষের জন্য খাদ্যসহায়তা কর্মসূচি বাড়ানো হচ্ছে, সেটিও ব্যাখ্যা দেওয়া হবে।

এছাড়া আগামী অর্থবছরে ভর্তুকি ও সুদ খাতে ব্যয় বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি করবে। এ ব্যয়ের অর্থ সংস্থান করাই বড় চ্যালেঞ্জ হিসাবে দেখছে অর্থ বিভাগ। ঋণের সুদ পরিশোধে ১ লাখ ২ হাজার কোটি টাকা এবং ভর্তুকিতে ১ লাখ ৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে।

যদিও আইএমএফ-এর শর্তে ভর্তুকি কমানোর কথা বলা হয়েছে। তবে ভর্তুকির অঙ্ক বাড়লেও সেটি বকেয়া পরিশোধেই বেশি ব্যয় হবে। আর ভর্তুকি কমাতে আগামী পহেলা সেপ্টেম্বর জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয় করা হবে। পর্যায়ক্রমে প্রতি তিন মাস অন্তর জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয় অব্যাহত থাকবে। সমন্বয় করা হবে গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্যও। এসব বিষয় সেখানে তুলে ধরা হবে। অর্থ বিভাগের মতে, বিশ্ববাজারে এরই মধ্যে কমতে শুরু করেছে সারের মূল্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য। ফলে এসব খাতে ভর্তুকির চাপ কিছুটা নমনীয় হবে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে।

এদিকে জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সব ধরনের ভাতা ও ভাতাভোগীর সংখ্যা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়। নতুন করে ২৪ লাখ সুবিধাভোগীর সংখ্যা বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়। ফলে এ খাতে বরাদ্দ থাকছে ১ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা।

প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে রাজস্ব বাড়ানোর ব্যাপারে আইএমএফ-এর শর্ত নিয়ে আলোচনা স্থান পেতে পারে। বিশেষ করে আগামী দিনে রাজস্ব আরও বাড়বে বলে আশা করছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। এজন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) রাজস্ব আয় বাড়াতে সংস্কার কার্যক্রমে হাত দেবে। ভ্যাট আদায় বাড়াতে জুন থেকে ইএফটি মেশিন স্থাপন কার্যক্রম শুরু হবে। বাড়ানো হবে কর আদায়ের ক্ষেত্র, যা তুলে ধরা হবে ওই বৈঠকে।

অর্থ বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, রিজার্ভ বাড়ানো নিয়ে এটি চ্যালেঞ্জ আছে। রিজার্ভ বাড়ানোর জন্য রেমিট্যান্সে ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে। আগামী দিনে যদি এসব সূচক ঠিক না হয়, তাহলে অর্থনীতিতে আরও চাপ সৃষ্টি হতে পারে। তবে ডলারের এই সংকট কাটাতে রপ্তানি ও রেমিট্যান্স আয় বাড়াতে জোর দেওয়া হবে। কারণ, ডলারের একটি বড় জোগান আসে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স থেকে। কিন্তু রেমিট্যান্স থেকে আয় কমছে। এজন্য রেমিট্যান্স বাড়াতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মতো একটি অ্যাপ খোলার সিদ্ধান্ত হয়। এই অ্যাপ ব্যবহারের জন্য প্রবাসীদের যাত্রার শুরুতে একটি কার্ড দেওয়া হবে। ওই কার্ড ব্যবহার করে যাতে তাৎক্ষণিক অ্যাপের মাধ্যমে একজন প্রবাসী তার পরিবারের কাছে রেমিট্যান্সের অর্থ পাঠাতে পারেন। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, এতে আগামী দিনে রেমিট্যান্স আরও বাড়বে।

খসড়া রাজস্ব আয় : আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫ লাখ কোটি টাকা। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের উৎস থেকে (এনবিআর কর) ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা, নন-এনবিআর কর ২০ হাজার কোটি টাকা এবং কর ব্যতীত প্রাপ্তি (এনটিআর) ৫০ হাজার কোটি টাকার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।

মোট ব্যয় : বাজেটের আকার প্রাক্কলন করা হয়েছে ৭ লাখ ৫৯ হাজার ৯৫৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে পরিচালনাসহ অন্যান্য ব্যয়ের আকার ৪ লাখ ৯৬ হাজার ৯৫৫ কোটি টাকা এবং উন্নয়ন প্রকল্প এডিপির আকার ২ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা। তবে পরিচালন ব্যয়ের মধ্যে সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন-ভাতায় যাবে ৭৭ হাজার কোটি, পণ্য ও সেবায় ৪০ হাজার কোটি, ঋণের সুদ পরিশোধে ১ লাখ ২ হাজার ৩৭৬ কোটি, ভর্তুকি প্রণোদনা ও নগদ ঋণ ২ লাখ ৫ হাজার কোটি এবং অন্যান্য খাতে ব্যয় ৭২ হাজার ৫৭৯ কোটি টাকা।

বাজেট ঘাটতি ও অর্থায়ন : আসন্ন বাজেটে সম্ভাব্য ঘাটতির (অনুদান ছাড়া) অঙ্ক দাঁড়াবে ২ লাখ ৫৯ হাজার ৯৫৫ কোটি টাকা। এটি মোট জিডিপির ৫ দশমিক ২ শতাংশ। অভ্যন্তরীণ ঋণ নেওয়া হবে ১ লাখ ৪২ হাজার ৮০০ কোটি টাকা এবং বৈদেশিক খাত থেকে নেওয়া হবে ১ লাখ ১৭ হাজার ১৫৫ কোটি টাকা।