ভারতীয় শিল্প-সাহিত্যে মুসলমানদের অবদান

আফরিন মিম
সেপ্টেম্বর ১, ২০২১

Share Now

মুসলিমভারত বহু নতুন বিদ্যা ও জ্ঞান বয়ে এনেছিল। তার মধ্যে সবচেয়ে অগ্রগণ্য ইতিহাসশাস্ত্র। ভারতে ইসলামী জ্ঞানচর্চা শুরুর আগে ইতিহাসশাস্ত্রের উল্লেখযোগ্য কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। ভারতবর্ষ ইতিহাসচর্চায় অনেক পিছিয়ে ছিল। ভারতীয় পাঠাগারগুলোতে সঠিকার্থে কোনো ইতিহাসগ্রন্থ ছিল না। ভারতে যা ছিল, তা হলো ধর্মীয় পুস্তক-পুস্তিকা ও উপাখ্যান, যেখানে বিভিন্ন যুদ্ধ ও চুক্তির বিবরণ আছে। যেমন—মহাভারত ও রামায়ণ। মুসলমানরা এখানে ইতিহাসশাস্ত্রের ওপর এমন সুবিশাল গ্রন্থাগার গড়ে তোলে, পৃথিবীতে যার দৃষ্টান্ত মেলা ভার। আল্লামা সাইয়েদ আবদুল হাই হাসানি (রহ.) ভারতবর্ষে মুসলিমদের বিরল অথচ বিপুল বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নয়নের বিবরণ তুলে ধরেছেন তাঁর ‘আস-সাকাফাতুল ইসলামিয়্যা ফিল হিন্দ’ গ্রন্থে। তিনি বলেছেন, গুস্তাভ লে বন তাঁর ‘হাদারাতুল হিন্দ’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘প্রাচীন ভারতের কোনো ইতিহাস নেই। তাদের গ্রন্থগুলোতে অতীতের গ্রহণযোগ্য কোনো সূত্রও পাওয়া যায় না। একাদশ খ্রিস্টাব্দে মুসলিম অভিযানের আগে ভারতে ইতিহাসচর্চা শুরু হয়নি। মুসলিম আগমনের পর মুসলিমদের অবদানে তার সূচনা হয়।’

ভারতবর্ষ মুসলিমদের কাছ থেকে চিন্তার উদারতা ও চিন্তার শক্তি লাভ করেছে। অর্জন করেছে সাহিত্য ও কবিতার নতুন অর্থ। যদি তারা তা অর্জন করতে না পরত তবে ভারতীয়দের মন ও মননে গবেষণা, বুদ্ধিবৃত্তি ও সাহিত্যের উন্নয়নের এই ধারা সৃষ্টি হতো না। ভারতবাসীর প্রতি মুসলমানের আরেকটি উপহার হলো উর্দু ভাষা ও সাহিত্য। উর্দু একটি বিস্তৃত ও সুন্দরতম ভাষা। মুসলিম আমলে যা জ্ঞান ও বুদ্ধিবৃত্তি চর্চার ভাষায় পরিণত হয়েছিল। আর তা হয়েছিল স্থানীয় একাধিক ভাষা ও বচনভঙ্গির সঙ্গে সংযোগে। ভারতবর্ষের জীবনযাত্রা, শিল্প ও নগরায়ণে মুসলিম প্রভাব ছিল সবচেয়ে শক্তিশালী ও প্রজ্জ্বল। তারা ভারতীয় সমাজে এমন এক নতুন জীবনধারা সূচনা করেছিল, যা প্রাচীন ধারাগুলো থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। যেমন—ইউরোপের মধ্যযুগীয় জীবনধারার তুলনায় ভিন্ন বর্তমান জীবনধারা।

আমরা যদি জানতে চাই মুসলিমরা ভারতবর্ষের উন্নয়ন-অগ্রযাত্রায় কী কী যুক্ত করেছে, আমাদের জন্য জানা আবশ্যক ইসলাম আগমনের আগে ভারত, ভারতের উন্নয়ন, নগরায়ণ, অর্জন ও জীবনযাত্রার মান কেমন ছিল। জানা প্রয়োজন, মুসলিমরা নতুন নতুন শহর নির্মাণ এবং ‘ভারতীয় মুসলিমসমাজ গঠন’ করার আগে ভারত কেমন ছিল। এবং মুসলিমরা ভারতবাসীকে যার সঙ্গে পরিচিত করেছে, ভারতীয় সমাজব্যবস্থায় যা যুক্ত করেছে এবং নগরগুলোতে যেভাবে অলংকরণ করেছে—তাও দেখা দরকার। মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা জহির উদ্দিন মুহাম্মদ বাবর (৮৮৮-৯৩৯ হি.) তাঁর আগমনের সময়ে ভারতের নগরগুলো, তার শিল্প, সভ্যতা ও সংস্কৃতি কেমন ছিল তার পরিষ্কার ছবি এঁকে গেছেন। তিনি তাঁর স্মৃতিচারণায় লিখেছেন : ‘এখানে ঘোড়ার জন্য কোনো মুক্ত চারণভূমি নেই। আঙুর, নাশপতি ও ভালো মানের ফল পাওয়া যায় না। বরফের অস্তিত্ব নেই। ঠাণ্ডা পানির পরিমাণও খুব সামান্য। নেই ‘হাম্মাম’ (বিশেষ গোসলখানা)। ভারতবাসী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চেনে না। এখানে অস্তিত্ব নেই প্রদীপ, বাতিঘর ও মশালের। প্রদীপের পরিবর্তে তারা তিন পায়াবিশিষ্ট কাঠ ব্যবহার করে, যার এক পায়াতে লোহার নল থাকে, দ্বিতীয় পায়ায় দুর্বল সলতে থাকে এবং ডান পায়াতে থাকে ছোট ছিদ্র, যা থেকে সলতে বেয়ে তেল নেমে আসে। রাতের বেলা এসব নিম্নমানের প্রদীপ ব্যবহার করেন স্থানীয় রাজা ও রাজন্যবর্গ। বাগান ও প্রাসাদগুলোতে প্রবহমান ঝরনা ও পানির ব্যবস্থা ছিল না। প্রাসাদের পরিচ্ছন্নতা ও বাতাস সরবরাহের ব্যবস্থাও ছিল শোচনীয়। বেশির ভাগ মানুষ খালি পায়ে হাঁটে, ছেঁড়া কাপড় পরে এবং নারীরা লুঙ্গি (শাড়ি) দিয়ে লজ্জা নিবারণ করে, যার এক প্রান্ত দিয়ে মাথা ঢেকে রাখে। (তুজুকে বাবরি)

সম্রাট বাবর তার আত্মজীবনী ও স্মৃতিচারণায় ভারতবর্ষের যে চিত্র যা লিপিবদ্ধ করেছেন, সে প্রসঙ্গে ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী জওয়াহেরলাল নেহরু বলেন, ‘বাবর যে ইতিহাস রচনা করেছেন, আমরা দেখি দক্ষিণ ভারতে সভ্যতা ছিল অত্যন্ত রুগণ। এর কারণ ছিল তৈমুরের আক্রমণে সৃষ্ট অস্থিরতা। এ কারণে ভারতের বহু জ্ঞানী, পণ্ডিত ও শিল্পী দক্ষিণ ভারত থেকে উত্তর ভারতে চলে যান। এসব বিপর্যয়কর অবস্থার কারণে ভারতীয়দের সৃজনশীলতা ও উদ্ভাবনী শক্তি শুকিয়ে গিয়েছিল। বাবর বলেছেন : এ দেশে দক্ষ শিল্পীর অভাব ছিল না। কিন্তু তাদের উদ্ভাবন ছিল মেধা ও উৎকর্ষশূন্য। …দক্ষিণ ভারতে ভারতীয় সভ্যতার পতন হয়েছিল, ঐতিহাসিকভাবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। প্রচলিত ধর্ম বিশ্বাস ও সমাজব্যবস্থা সামাজিক সংস্কার ও অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করেছে।’ (দ্য ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া : ১/৫১০)

ভারতে যদিও সবুজের প্রাচুর্য ছিল, তবু ফল-ফলাদির অভাব ছিল। আর যে ফল পাওয়া যেত তার বেশির ভাগ ছিল গ্রীষ্মকালীন। আর তাও প্রয়োজন পূরণে পর্যাপ্ত ছিল না। এরপর যখন মোগলরা এলো—তারা উচ্চ রুচিসম্পন্ন এবং ফলপ্রধান অঞ্চলের সন্তান। তারা ভারতে বহু ফলের চাষাবাদ শুরু করে। বিস্তারিত জানতে ‘তুজুকে বাবরি’ ও ‘তুজুকে জাহাঙ্গিরি’ দেখা যেতে পারে। এ ছাড়া তারা স্থানীয় কিছু ফলের জাতোন্নয়নে ভূমিকা রাখে। ফলে তা আরো সুস্বাদু ও মনোহরী হয়। যেমন—আম ভারতের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও সুস্বাদু ফল। আমগাছ শুধু বিচি থেকেই উৎপন্ন হতো। কিন্তু মোগলরা ‘কলম’ পদ্ধতি প্রয়োগ করে আমের জাত উন্নয়নে অবদান রাখে। ফলে মোগল শাসনের শেষভাগে আমের প্রজাতি দাঁড়ায় শতাধিকে।

‘আল মুসলিমুনা ফিল-হিন্দ’ থেকে আতাউর রহমান খসরুর ভাষান্তর

সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভি (রহ.)